টয়োডা থেকে আজকের টয়োটা

টয়োডা থেকে আজকের টয়োটা কিভাবে দখল করে নিলো গাড়ির সাম্রাজ্য ? অন্যসব বৃহত্তর কোম্পানি গুলোকে পিছনে ফেলে এগিয়ে এলো সম্মুখে ? একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে সাড়া জাগালো পৃথিবীতে ? সেই টয়োটা নিয়েই আমার আজকের এই প্রতিবদেন।

টয়োটা (Toyota) একটি নাম, একটি ব্রান্ডবিশ্বের বৃহত্তম অটোমোটিভ এক কোম্পানিবাংলাদেশের মেগা সিটিগুলোতে বসবাস করার কারনে এই নামটির গাড়ি দেখতে দেখতে আমরা এতোটাই অভ্যস্থ হয়ে গেছি যে, এর লোগোটি ১০০০ লোগোর মাঝখান থেকেও অনায়াসেই যে কেউ বলে দিতে পারি।

আজকের বিশ্বে গাড়ি উৎপাদন এবং রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষেত্রে বৃহত্তম অটোমোবাইল কোম্পানি এই টয়োটা মোটর কর্পোরেশন। যার প্রধান কার্যালয় টয়োটা সিটি । গাড়ি, বাণিজ্যিক এবং ট্রাক, বাস এবং অটো যন্ত্রাংশ তৈরিতে নিযুক্ত এই কোম্পানী ।

টয়োটার যাত্রা শুরু :

টয়োডা থেকে আজকের টয়োটা
সাকিচি টয়োডা; Image Source: SteemKR

টয়োটার যাত্রা 1891 সালে, জাপানে। টয়োডা নামে। যা ছিলো তাদের পারিবারিক ব্যবসা।  কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়া সাকিচি টয়োডা, যিনি জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত উদ্ভাবক ও শিল্প উদ্যোক্তা হিসেব পরিচিত পেয়েছিলেন। তিনি জাপানে প্রথম ব্যক্তি যিনি তার নিজস্ব স্বয়ংক্রিয় তাঁত তৈরি করেছিলেন। এক পর্যায় তার হাতেই বড় হয়ে ওঠে পারিবারিক টয়োডা ব্যবসাগুলো। তার মাঝে একটি ছিল টয়োডা অটোমেটিক লুম ওয়ার্কস (Toyoda Automatic Loom Works), যেটি তিনি শুরু করেছিলেন ১৯২৬ সালে। ‘জাপানী উদ্ভাবকদের সম্রাট’ খ্যাত টয়োডা এই তাঁতশিল্পের কোম্পানির জন্য বিভিন্ন রকমের যুগান্তকারী যন্ত্রও আবিষ্কার করেন।

টয়োটা নামকরনের নেপথ্যে :

টয়োটা গাড়ির প্রথম পেটেন্ট ডিজাইন করেছিলেন কিচিরো টয়োডার বাবা, সাকিচি টয়োডা Sakichi Toyoda। আর প্রতিষ্ঠাতার নাম অনুসারে এই স্টার্ট আপটির নাম ছিল টয়োডা। তিনি ১৯২৪ সালে টয়োডা মডেল জি আবিষ্কার, ডিজাইন এবং পেটেন্ট করেছিলেন।

কিচিরো টয়োডা
কিচিরো টয়োডা; Image Source: Wikimedia Commons

১৯৩০ সালে অবসান হয় সাকিচির কর্মজীবন। পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন ছেলেরা। তার ছেলে কিচিরো টয়োডা  মাত্র 36 বছর বয়সে তাঁতশিল্প অর্থাৎ টেক্সটাইল ব্যবসা থেকে মনোযোগ গাড়ির দিকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার ভাইকে বুঝিয়ে রাজি করান এ ব্যাপারে, কারণ তার ভাই-ই আসলে পারিবারিক ব্যবসার প্রধান ছিলেন তখন। তাই ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কিচিরোর পরামর্শে তার ভাই তাঁত ছেড়ে গাড়ি ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। কিচিরোকে তার সহকর্মীরা ডাকতেন ‘জাপানের থমাস আলভা এডিসন‘ বলে। উদ্ভাবনের প্রতিভাটা তার মাঝে ছিল বাবার মতোই। তার একটি সিদ্ধান্তই পাল্টে দিয়েছিল বিংশ শতকের ইতিহাস! এরপর ১৯৩৬ সালে টয়োডা নামটি একটু পরিবর্তন করে রাখা হয় টয়োটা। কেননা, টয়োডা শব্দের অর্থ উর্বর ধানের শীষ, যা একটি গাড়ি নির্মাতাণকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে ছিলো একদমই বেমানান।  

জাপানি ভাষায় টয়োটা লিখতে হলে আপনাকে বার ব্রাশ স্ট্রোক করতে হবে। আর জাপানিরা বিশ্বাস করেন যে হচ্ছে লাকি নাম্বার। যা সৌভাগ্য এবং সমৃদ্ধি নিয়ে আসে।আর টয়োটা নামটি সত্যিই সৌভাগ্য নিয়ে এসেছ।

টয়োটা সিটি :

জাপানের করোমো শহরে ১৯৩৭ সালের ২৮ আগস্ট টয়োটা মোটর কর্পোরেশন আত্মপ্রকাশ করে। তবে টয়োটার এই ব্যাপক সাফল্যের কারণে মানুষ ওই এলাকাকে করোমা নামের পরিবর্তে টয়োটা সিটি বলেই বেশি চিনতো। আস্তে আস্তে করোমো নামটি একদমই আড়ালে চলে যায়, আর সিটির নামকরণ করা হয়টয়োটা সিটি 

টয়োটার অগ্রযাত্রার শুরু

টয়োটা আনুষ্ঠানিকভাবে অটোমোবাইল তৈরি উৎপাদন শুরু করে ১৯৩৩ সালে। তখনএটি টয়োডা অটোম্যাটিক লুম ওয়ার্কসের একটি বিভাগ ছিলো মাত্র। আর টয়োটার প্রথম উৎপাদিত গাড়ি দুটি ছিলো এ১ এবং ১৯৩৫ সালের জি১ ট্রাক।

১৯৩৭ সাল পর্যন্ত নির্মিত প্রতিষ্ঠানটির সকল গাড়ি ছিলো টয়োডা অটোম্যাটিক লুমওয়ার্কসের বিভাগে তৈরি। আর টয়োডা নামেই এই গাড়িগুলো বিক্রি করা হয়েছিলো। ১৯৩৭ সাল থেকে টয়োটা কোম্পানি স্বাধীনভাবে যাত্রা শুরু করে এবং টয়োটা নামে বিক্রি শুরু হয়। 

১৯২৩ সালের গ্রেট কান্টো ভূমিকম্প জাপানে আঘাত হানলে দেশের রেল পরিষেবা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় আর গাড়ির চাহিদা ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। এই সুযোগটি লুফে নেয়ার চেষ্টা করে আমেরিকান অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রি ফোর্ড এবং ইংরেজ অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রি জেনারেল মোটরস। তারা জাপানে আসে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে। কিন্তু জাপানিদের মধ্যে দেশীয় যন্ত্রাংশ এবং পণ্য ব্যবহার করার প্রবণতা দেখে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। 

বিশ্বযুদ্ধের আগেই টয়োটা তার প্রথম মডেলের গাড়ি তৈরি করেছিলো, আর সবাই টয়োটার গাড়ির দিকেই মনোযোগী হয়ে ওঠে। টয়োটার কারণে ফোর্ড এবং জেনারেল মোটরসের ব্যবসা প্রায় বন্ধের জোগার হয়। তাই এই কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়। ফলস্বরূপ, টয়োটা মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত গাড়ির প্রস্তুত কারক হয়ে ওঠে।

টয়োটার সফলতা :

টয়োডা থেকে আজকের টয়োটা ‘র সবার শীর্ষে উঠে  আসার জন্য কেবলমাত্র ভাগ্যই ছিলো না। বৃহত্তম এই কোম্পানিটির শুরুর যাত্রাও লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই গিয়েছে। আর সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই সর্বোচ্চ স্থান দখল করে নিয়েছে টয়োটা। বছরের পর বছর ধরে, টয়োটা ধীরে ধীরে উন্নত হয়েছে এবং অন্যান্য সকল অটোমোবাইল নির্মাতাদের ছাড়িয়ে গেছে। টয়োটা প্রথম থেকেই নির্ভরযোগ্য এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী গাড়ি তৈরির দিকে মনোনিবেশ করেছিলো এবং বিশেষ করে এই ফ্যাক্টরটিই টয়োটার সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে।

বাড়তি যত্নের সাথে গাড়ির প্রতিটি খুঁটিনাটির দিকে নজর দিয়েছিলো টয়োটা। এমনকি গাড়ির দরজা খোলার এবং বন্ধ করার শব্দও তাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। আর এভাবেই টয়োটা নিজের গাড়িগুলোকে করে তুলেছে অনন্য এবং ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।

টয়োটা নিয়মিতভাবে উন্নতি অব্যহত রেখেছে, আর এর মাধ্যমে তাদের প্রতিযোগীদের থেকে আলাদা হয়ে উঠেছে। অন্য নির্মাতাদের জন্য টয়োটাকে অনুকরণ করে বাজারের শীর্ষে ওঠা ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে ওঠে। আর নির্ভরযোগ্য এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী গাড়ি গুলো টয়োটার বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়।

টয়োটার ব্যর্থতা :

তবে প্রতিটি সফলতার বিপরীতেই কিছু ছোটো ব্যর্থতা থাকে। আর টয়োটাও এর বাইরে ছিলনা। বিশ্বজুড়ে বেশ কয়েকটি ক্যাম্পেইন থেকে টয়োটাকে তাদের গাড়ি এবং ট্রাকগুলো ত্রুটির কারণে প্রত্যাহার করতে হয়েছে।

২০০৯ সালে টয়োটা তাদের যানবাহনের ত্রুটিপূর্ণ গতিবৃদ্ধির বিষয়ে বেশ কয়েকটি অভিযোগ নথিভুক্ত করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মিলিয়ন গাড়ি এবং ট্রাক প্রত্যাহার করতে হয় টয়োটাকে। পরবর্তীতে, ২০১২ সালে টয়োটাকে আবারো বিশ্বব্যাপী .৪৩ মিলিয়ন গাড়ি প্রত্যাহার করতে হয়। এবার সমস্যা ছিলো পাওয়ার উইন্ডোর সুইচ গুলোয়।

টয়োটার বর্তমান অবস্থা :

টয়োডা থেকে আজকের টয়োটা ২০১৪ সালে বিশ্বের বৃহত্তম অটোমোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। প্রায় ৫০ টিরও বেশি বিদেশী উৎপাদন কারখানা নিয়ে টয়োটা হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ব্র‍্যান্ড। টয়োটা কোম্পানির শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে আছে বিশ্বের প্রায় ৩০ টি দেশে। শুধুমাত্র ২০২১সালেই টয়োটা প্রায় সাড়ে মিলিয়ন গাড়ি তৈরি করেছে, এবং আয় করেছে প্রায় ২৫৮.বিলিয়ন ডলার।

টয়োটার লক্ষ্যই ছিলো সব সময় সাশ্রয়ী মূল্যের গাড়ি তৈরি করার । আর তাতে পেয়েছে সফলতা। অর্জন করেছে গাড়ি তৈরীর শ্রেষ্ঠত্বের সুনাম। নির্ভরযোগ্য এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী গাড়ি গুলো টয়োটার বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।

মজার ব্যাপার, টয়োটার যাত্রা যে তাঁত শিল্প থেকে শুরু হয়েছিল, তা কিন্তু কখনোই বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। আজও চলছে সেই শিল্প, পার্থক্য কেবল এই- তখন কম্পিউটারের অস্তিত্ব ছিল না, আর আজ তাদের সেই তাঁতশিল্পের সবই কম্পিউটারচালিত। সেই তাঁতের সৌভাগ্য থেকেই তো টয়োটার জন্ম, বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষের প্রিয় ব্র্যান্ড হয়ে ওঠার সূচনা। গুণগত মান হোক, কিংবা দাম- সবদিক থেকেই টয়োটা যেন দুনিয়াজুড়ে গাড়ির বাজারের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাম। মানুষ ভালোবাসবেই না বা কেন? পরিবারের সবাইকে সাথে নিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে গা এলিয়ে অবিরাম ছুটে চলার সাথী হিসেবে টয়োটার জুড়ি খুঁজে পাওয়াই যে ভার !