বর্বরদের কখনোই ক্ষমা করেনা ইতিহাস

বর্বরদের কখনোই ক্ষমা করেনা ইতিহাস ! পাচ শতক পেরিয়ে গেলেও আমেরিকার আবিস্কারক হিসেবে পরিচিত কলম্বাসকে কিন্তু ইতিহাস ছাড়েনি। আমেরিকা জয়ের পরে তার সেই নির্মমতার প্রতিকি বিচার শুরু হয়েছে।

১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর।

ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নেতৃত্বে একদল অস্ত্রধারি তিনটি জাহাজে চড়ে আমেরিকার বাহামাস দ্বিপে পৌছান সরলমনা স্থানিয় আদিবাসিরা তাদেরকে অতিথি হিসেবে স্বাগত জানান। কলম্বাসের একটি ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ মেরামতও করে দেন তারা।

অভ্যর্থনা জানাতে আসা আদিবাসিদের দেহে স্বর্ণের অলঙ্কার দেখে কলম্বাস অনুমান করেন আশেপাশের কোথাও স্বর্ণের খনি রয়েছে। আদিবাসিদের সরলতা কলম্বাসকে মুগ্ধ করে জন্য যে, তিনি খুবই কম পরিশ্রমে ওই ভূখণ্ডের সব কিছু নিজের দখলে নিতে পারবেন।

হলো তাই.. তিনি আমেরিকার মূল মালিক আদিবাসিদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করেন এবং স্পেনে গিয়ে আরও এক হাজার দুইশইউরোপিয়কে সঙ্গে নিয়ে আসেন।

শুরু হয় নির্মমতা, চলে গণহত্যা। কলম্বাস বাহিনি হিস্পানিওলা দ্বিপের একটি প্রদেশে ১৪ বছরের উপরের সব আদিবাসিকে তিন মাস পরপর একটা নির্দিষ্ট পরিমান স্বর্ন জমা দেওয়ার নির্দেশ জারি করেন। এই নির্দেশ মানতে যারাই ব্যর্থ হতো তাদেরই দুই হাত কেটে ফেলা হতো। হাত কাটার পর তারা রক্তপাতে মারা যেত।

অনেকে বাচার জন্য পালানোর চেষ্টা করতো। তাদেরকে হিংস্র কুকুর দিয়ে খুজে বের করে নির্মম অত্যাচারের মাধ্যমে মেরে ফেলা হতো। অনেক আদিবাসিকে জিবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে।

হিস্পানিওলা দ্বিপে বসবাসকারিরা ছিল আরাওয়াক গোত্রের। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, কলম্বাসের নেতৃত্বাধিন ইউরোপিয় বাহিনির নির্মমতা সইতে না পেরে ৫০ হাজার আদিবাসি বিষ খেয়ে গনআত্মহত্যা করেছিলেন। মায়েরা তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতেন যাতে ইউরোপিয়রা ওই বাচ্চাদেরকে কুকুরের খাবারে পরিনত করতে না পারে। এরপরও যারা বেচে ছিলেন তাদেরকে দাসে পরিনত করেন কলম্বাস।

কলম্বাসের সময়ের কিছু নির্মমতার ইতিহাস উঠে এসেছে তার নিজস্ব জার্নাল চিঠিতে। আরও তথ্য পাওয়া যায় স্পেনের ঐতিহাসিক বার্তোলমে দা লাস কাসাস এর লেখাহিস্টোরিঅব দ্য ইন্ডিজগ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, কলম্বাস বাহিনি তাদের ছুরি তলোয়ারের ধারপরিক্ষা করার জন্যও আদিবাসিদের টুকরো টুকরো করে কাটতো, নিষ্পাপ শিশুদের শিরচ্ছেদ করতো।

কলম্বাস যাদেরকে রেড ইন্ডিয়ান বলে নামকরন করেছিলেন সেই আদিবাসিদের একটা বড় অংশকে নিশ্চিহ্ন করার পর ইউরোপিয়রা নিজেদের বিলাসি জিবন নিশ্চিত করতে একদল সেবকের প্রয়োজন বোধ করে। তারা আফ্রিকা মহাদেশে গিয়ে মানুষ ধরে আনতে শুরু করে। এভাবেই আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের আগমন। তারা স্বেচ্ছায় আমেরিকায় আসেননি, তাদেরকে জোর করে ধরে আনা হয়েছে।

বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ লেখক অ্যালেক্স হেলি আমেরিকায় তার নিজের প্রথম পূর্বপুরুষের অনুসন্ধানে ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে ছিলেন। সেই গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে লেখারুট্স: দ্য সাগা অফ এন অ্যামেরিকান ফ্যামিলিবইয়ে আফ্রিকা থেকে মানুষ ধরে আনার কিছু ঘটনার প্রামাণ্য বর্ণনা রয়েছে। তিনি দির্ঘদিন ধরে গবেষণার পর জানতে পারেন আমেরিকায় তার প্রথম পূর্বপুরুষের নাম কুন্তা কিন্তে।

দ্যা রুটসনামে দির্ঘ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। গাম্বিয়া থেকে কুন্তা কিন্তেকে ধরে নিয়ে আসেই উরোপীয়রা। কুন্তা কিন্তে আমেরিকায় পৌছার খুটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন অ্যালেক্স হেলি।

কুন্তা কিন্তে জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে ইউরোপিয়দের অনুচরদের মাধ্যমে অপহৃত হন। এরপর আত্বিয়স্বজনেরা অনেক খোজাখুজি করেও তার কোনো সন্ধান পাননি। ১৭৬৭ সালে এক ইউরোপিয় দাস ব্যবসায়ি অন্যান্য পন্যের সঙ্গে গাম্বিয়ার যে ১৪০ জন মানুষকে জাহাজে করে আমেরিকায় নিয়ে এসেছিল তার মধ্যে কুন্তা কিন্তেও ছিলেন। জাহাজটি অ্যানাপোলিসের বন্দরে এসে থামে। অ্যানাপোলিস বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত। আমেরিকায় পৌছার আগেই পথে নির্মমতায় মারা যায় ৪২ জন গাম্বিয়ান। বেচে যাওয়া ৯৮ জনের একজন হলেন কুন্তা কিন্তে। তিনি ছিলেন মুসলমান।

অথচ কলম্বাসের আগেও অনেকে আমেরিকা গিয়েছিলেন। অনেক মুসলিম নাবিকও আমেরিকা গিয়েছিলেন তার প্রমাণ রয়েছে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান কয়েক বছর আগে নতুন করে এই প্রসঙ্গটি সামনে আনলে নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। কিন্তু তাদের কারো চিন্তায়ই কলম্বাসের মতো এমন বর্বরতা ঢোকেনি।

কিন্তু ইতিহাস কত নির্মম। ৫০০ বছর পরে হলেও ইতিহাসে মহাবির হিসেবে জায়গা করে নেয়া কলম্বাস আজকে বর্বর, নির্মম, পাষণ্ড হিসেবে তার চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্নস্থানে জায়গা নেয়া তার ভাষ্কর্য আজকে অপসারিত হচ্ছে, ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে, ভাষ্কর্যের গায়ে লাল রঙ মেখে তার রক্ত পিপাসু চরিত্র উন্মোচন করা হচ্ছে। জনবিরোাধ, স্বৈরাচার, বর্বরদের ইতিহাস কখনো ক্ষমা করে না। আজ না হোক কাল, মৃত্যুর পরে হলেও জনগণ তাদের গলায় দড়ি বেধে ইতিহাসের কাঠগড়ায় হাজির করবে। ক্রিস্টোফার কলম্বাস তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

নির্মম হলে চিরসত্য যে, বর্বরদের কখনোই ক্ষমা করেনা ইতিহাস !

অবাক প্রিথিবির আরো কিছু :