স্তনকর একটি জঘন্য কর ব্যবস্থা

স্তনকর একটি জঘন্য কর ব্যবস্থা ’র নাম। একটা সময় ছিলো যখন হিন্দু সমাজের নিম্নশ্রেনির মহিলাদের নিজেদের বক্ষ আবৃত করার অনুমতি ছিল না। কোনও মহিলা শরিরের উর্ধাঙ্গ ঢাকলে তাকে দিতে হতো কর। যার স্তন যত বড়, করও তত বেশি –  হ্যা, এক বর্বর জঘন্য কর আইনের  ছোটটো একটুসখানি ইতিহাস তুলে ধরবো আজ।

স্তনকর :

দক্ষিন ভারতের নিম্নবর্নের হিন্দু মহিলারা বুকের উপর কোনো কাপড় পরিধান করতে পারতোনা। তাদের স্তন সম্পুর্ন রুপে নগ্ন রাখতে হতো। বুকের উপর কোনো কাপড় পরিধানের ইচ্ছে পোষন করলেই তাকে স্তনকর বা ব্রেষ্ট ট্যাক্স প্রদান করতে হতো।

মহিলাদের স্তন আবৃত রাখার জন্য যে কর প্রদান করতো, তাই স্তনকর বা Breast Tax নামে পরিচিত। আঞ্চলিক ভাষায় এর আরেকটি নাম হলো মুলাক্কারাম Mulakkaram.

যাদের জন্য প্রযোজ্য :

প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বুকের উত্থিত মাংশ পিণ্ডকে স্তন বলা হয়। দক্ষিন ভারতের কেরালা রাজ্যে নিম্ন-বর্নের হিন্দু মহিলারা শরিরের উপরিভাগে কোনো বসন রাখতে পারতো না। সব সময় উন্মুক্ত রেখেই চলাফেরা করতে হতো। কেউ যদি স্তন ঢেকে রাখতে চাইতো তাহলে তাকে রাজ্যের বিধান অনুযায়ি স্তনকর প্রদান করতে হতো। উনিশ শতকের প্রথম দিকে এই জঘন্য করের ব্যবস্থা প্রচলিত ছিলো। আত্নমর্যাদা রক্ষার জন্যে নিম্ন বর্নের মহিলারা বাধ্য হয়েই এই কর প্রদান করে থাকতো।

স্তনকর প্রদানের সময়কাল :

এই স্তনকরের প্রচলন ছিলো আজ থেকে কয়েক শ বছর আগে ভারতের কেরালা অঙ্গরাজ্যে। যেখানে শুধু ব্রাম্মন মহিলারা ব্যতিত অন্যান্য সকল হিন্দু মহিলাদের স্তন সম্পুর্ন উন্মুক্ত রেখে চলাফেরা করতে হতো। শুধুমাত্র ব্রাহ্মন মহিলারা পাতলা এক টুকরো কাপড় দিয়ে তাদের স্তন ঢেকে রাখতে পারতো । নিম্ন-বর্নের মহিলারা তাদের স্তন ধেকে রাখতে চাইলে তাদের স্তনের সাইজ অনুযায়ি এই জঘন্য ও বর্বর ব্রেষ্ট ট্যাক্স বা স্তনকর প্রদান করতে হতো।

কখন, কার রাজত্বকালে এই আইন চালু ছিলো :

সে সময় কেরালার রাজা ছিলেন ত্রিভাঙ্কুর/ত্রিবাঙ্কুর। আজব দেশের এই আজব শাসক বিভিন্ন আজব আজব করের নামে নিম্নবর্নের বা দলিত শ্রেনির মানুষকে শোষণ করতেন। আর সমাজের উচু শ্রেনির কিছু ব্যক্তি তাদের সহযোগিরা ভোগ করতো সকল সুযোগ সুবিধা।

তার সময়ে শুধু যে স্তনকর প্রচলিত ছিলো তা নয়, নিম্ন বর্নের পুরুষ মহিলাদের উপরেই ছিলো যেন যত আক্রোশ। তারা কোনোারকম অলংকার পরলেও সেই পরিধেয় অলংকারের জন্য কর প্রদান করতে হতো । পুরুষেরা গোফ রাখতে চাইলেও তাদের কর প্রদান করতে হতো। এসবের পরেও সবচেয়ে জঘন্য আইন ছিলো এই স্তনকর। স্তনকর বা স্তনশুল্ক। স্থানিয় ভাষায় যাকে বলা হতোমূলাক্করম

সব হিন্দু মহিলাদের জন্য এই আইন প্রযোজ্য ছিল না। হিন্দুদের মধ্যে যারা উচু বর্নের ব্রাহ্মনশ্রেনির মহিলা ছিল, তাদের এই কর বা ট্যাক্স দিতে হতো না এবং তারা বুকের ওপর কাপড় পরিধান করার একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করতো। আর এই আইনের করাতলে শোষিত হতো নিম্নবর্নের নারিরা।

স্তনকরের  ধরন :

মহিলাদের স্তনের সাইজের উপর ভিত্তি করেই এই কর ধার্য করা হতো। যেসব নিম্নবর্নের হিন্দু মহিলার স্তন ছোট ছিল, তাদের অল্প কর বা অল্প ট্যাক্স প্রদান করতে হতো। কিন্তু সমস্যা ছিল সমস্ত মহিলাদের, যাদের স্তনের আকার ছিল বড় । তাদের বড় আকারের স্তনের জন্য বেশি পরিমান কর বা ট্যাক্স প্রদান করতে বাধ্য করা হতো। এক কথায় ছোট স্তনের জন্য ছোট কর বড় স্তনের জন্য বড় কর ।

তবে বেশিদিন টিকতে পারেনি ত্রিভাঙ্কুর/ত্রিবাঙ্কুর রাজার প্রচলিত এই আইন । নিচু বর্নের লোকদের সম্মিলিত প্রতিবাদে এক সময় ধ্বংস হয় এই আইন। নিম্নবর্নের এক মহিলাই সর্ব প্রথম এর প্রতিবাদ করেছিল।

স্তনকরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি সেই মহিলার আত্নহুতি :

নাঙ্গেলি নামের এক নিম্নবর্নের মহিলাই সর্বপ্রথম প্রতিবাদ করে এই ব্রেষ্ট ট্যাক্সের বিরুদ্ধে। ঐ নারি তার স্তন ঢেকে রাখে। শুল্ক আদায়ের কর্মকর্তা নাংগেলির স্তন আবৃত দেখে কর প্রদানের জন্য চাপ প্রয়োগ করে। নাংগেলি তা দিতে অস্বিকার করে। এক পর্যায়ে শুল্ক কর্মকর্তার চাপের মুখে পড়ে সে তার স্তন দুটো কেটে কলাপাতায় মুড়িয়ে কর্মকর্তার হাতে তুলে দেয়। কর্মকর্তা এতে অবাক হয়। স্তন কর্তনের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে নাঙ্গেলির মৃত্যু হয়। নাঙ্গেলির স্বামি চিরুকান্দান নাঙ্গেলির বিকৃত মৃতদেহ দেখে শোক সহ্য করতে পেরে নাঙ্গেলির শেষকৃত্যে ঝাপিয়ে পড়ে চিতায় আত্মহুতি দেন

নিজের নারিত্ব অভিশাপ হয়ে বেচে থাকুক নাঙ্গেলি তা চাননি। তিনি বর্নপ্রথাও মানতে চাননি। তিনি চাননি, ভোগ্য পন্যের মতো তার শরিরের উপর কর আরোপিত হোক। এর প্রতিবাদ স্বরূপ সে তার স্তন কেটে ফেলে । তার মৃত্যু বরনের ঘটনায় সকলে ফুসে উঠে। মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। এক পর্যায়ে রাজা ত্রিভাঙ্কুর/ত্রিবাঙ্কুর রহিত করতে বাধ্য হয় জঘন্য বর্বর স্তনকর আইন

ধর্ম ব্যবসায়ি পুরোহিতদের ধর্ম ব্যবসা :

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়টি ছিলো তখনকার খোদ হিন্দু পুরোহিতরাই বলেছিল যে, নিচু বর্নের নারিদের শরিরের উপরের অংশ আবৃত করা ধর্ম বিরোধি। স্তনকর একটি জঘন্য কর ব্যবস্থা জেনেও তারা তাদের স্বার্থ সিদ্ধি এবং রাজার মনোবাসনা পুরনে অন্যায় কর্মকে ন্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

পরের প্রেক্ষাপট :

নাঙ্গেলির মৃত্যুতে স্তনকর রহিত হলেও শরির আবৃত অনাবৃত রাখা না রাখা নিয়ে অনেক ঘটনার জন্ম হয় ভারতবর্ষে। ১৮৫৯ সালে এই বিষয়টি নিয়ে দক্ষিণ ভারতে একটি দাঙ্গাও সংগঠিত হয়। এই দাঙ্গাটিকাপড়ের দাঙ্গাহিসেবে পরিচিত। দাঙ্গার বিষয় ছিলো, নারীদের শরীর আবৃত রাখার অধিকার যে অধিকারের জন্যে ১৮৫৯ সালের দাঙ্গার অনেক বছর আগেই প্রান দিয়েছিলেন এক হতভাগ্য নারি নাঙ্গেলি।

শেষকথা : কর বা ট্যাক্স শব্দটি যুগে যুগে মানুষকে শুধু নির্যাতন করে গেছে। রাজ্য প্রধান, রাজা, প্রধানমন্ত্রি যখন যারাই দেশের মসনদে আরোহন করেছে তারা সকলেই দেশের প্রজা বা নাগরিকদের শাসন শোষনই করেছে। জুলুম নির্যাতন, ক্ষমতায় ঠিকে থাকা, নিজেদের আখের গোছানোর অন্যতম এক খর্গ হিসেবে ব্যবহার করেছে এই ট্যাক্স নামক বর্বর জঘন্য আইন। জোড় করে চাপিয়ে দিয়েছেন জনগরেন উপর। মসনদের অধিকারিরা এখনো এক এক ভাবে, এক এক তরিকায় বলবত রেখেছে ট্যাক্স প্রদানের এই নির্মম ষ্টিম রোলার।

অনুরোধে : স্তনকর একটি জঘন্য কর ব্যবস্থা আর্টিকেলের প্রয়োজনেই আমি ছবিগুলো সংযুক্ত করেছি । দৃষ্টিকটু মনে হতে পারে। দয়া করে ক্ষমা করে দিবেন।