বৃটিশ বিরোধি আন্দোলনে আত্নত্যাগি : ক্ষুদিরাম

বৃটিশ বিরোধি আন্দোলনে আত্নত্যাগি ক্ষুদিরাম বসু । বৃটিশদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বিদ্রোহ করা এক আত্নত্যাগির নাম। বৃটিশ বিরোধি আন্দোলেনের প্রথম এক বিপ্লবির নাম । যাকে ফাসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে বর্বর বৃটিশরা।

ক্ষুদিরামের নামের নেপেথ্য :

জন্মস্থান মেদেনিপুর, হাবিবপুর গ্রামে। ক্ষুদিরামের জন্মের পর্বেই তার দুই ভাই মারা যায় খুব অল্প বয়সে। ক্ষুদিরাম জন্ম নিলে তৎকালিন প্রথা মোতাবেক তার জিবন রক্ষা পাবে এই বিশ্বাসে তার বাবা-মা তিন মুঠো খাদ্য শস্য বা ক্ষুদের বিনিময়ে ক্ষুদিরামের বড় বোনের কাছে ক্ষুদিরামকে দিয়ে দেন। ক্ষুদের বিনিময়ে দেয়া হয় বলে তার নাম হয় ক্ষুদিরাম।

ক্ষুদিরামের বিপ্লবি হয়ে ওঠা :

ভারতবর্ষে তখন বৃটিশদের অপশাসন চলমান । বৃটিশদের অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার জাতি। ভেতরে ভেতরে চলছে বৃটিশ বিরোধি আন্দোলনের নিল নকশা । অনুশিলন সমিতি  বৃটিশ বিরোধি আন্দোলনের এক গুপ্ত সংগঠন । যা দার্শনিক, সাধক ও দেশভক্ত শ্রি অরবিন্দু এবং স্বামি বিবেকানন্দ, সমাজ সংস্কারক ভগিনি নিবেদিতা’র পরিচালনায় পরিচালিত।  ১৯০২ ও ১৯০৩ সালে ক্ষুদিরাম দেশ প্রেমিক এই সব নেতাদের বক্তৃতা আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যোগ দেন “অনুশিলন সমিতি”-তে। পরবর্তিতে সাধক ও দেশভক্ত শ্রি অরবিন্দুর আপন ছোট ভাই বারিন্দ্র কুমার ঘোষের সংস্পর্শে তিনি আসেন। এবং মাত্র পনের বছর বয়সে ব্রিটিশদের অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রচার পত্র বিলির অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে বৃটিশদের হাতে আটক হন।  মাত্র ১৬ বছর বয়স কালে পুলিশ স্টেশন সহ চিহ্নিত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে তিনি বোমা পেতে রাখতেন।

ক্ষুদিরামের বোমা হামলা করার প্রেক্ষাপট :

সামরিক ও রাজনৈতিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে ভারত খেকে ইউরোপে গিয়েছিলেন আরেক বিপ্লবি হেমচন্দ্র কানুনগো দাস। সে সময় প্যারিসে তার সাথে পরিচয় ঘটে নির্বাসনে থাকা রাশিয়ান বিপ্লবি নিকোলাস সাফ্রানস্কির।  সাফ্রানস্কি ছিলেন বোমার তৈরিতে অভিজ্ঞ।  হেমচন্দ্র তার কাছ থেকে বেমা তৈরির কৌশল আয়ত্ব করেন। এবং দেশে ফিরে এসে বারিন্দ্র ঘোষ এবং হেমচন্দ্র মিলে ঠিক করেন আলিপুর প্রেসিডেন্সি কোর্টের প্রধান ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ড এর উপর বোমা হামলার ।

কিংসফোর্ড ইতোমধ্যে স্বামি বিবেকানন্দের বড় ভাই, বিপ্লবি পত্রিকা ‘যুগান্তর‘-এর সম্পাদক ভুপেন্দ্র নাথ দত্তকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেছিলেন। যুগান্তর পত্রিকাটি ব্রিটিশদের অপশাসন আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আরো লেখালিখি করলে ১৯০৮ সালে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে আরো পাচটি গুরুতর অভিযোগ এনে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়।

ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড বিপ্লবি সুশিল সেন সহ কিশোর বিপ্লবিদের বিরুদ্ধে কঠোর শারিরিক নির্যাতনের দণ্ডাদেশ দিয়ে কুখ্যাতি অর্জন করেন।

বোমা হামলা : 

বারিন্দ্র ঘোষ এবং হেমচন্দ্র মিলে কিংসফোর্ডকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্ষুদিরাম বসু আর (বর্তমান) বাংলাদেশের বগুড়া জেলার বিপ্লবি প্রফুল্ল চাকিকে। তারা তিন সপ্তাহ ধরে পুলিশের চোখ ফাকি দিয়ে কিংসফোর্ড এর গতিবিধির উপর নজর রাখেন। এক পর্যায়ে হামলার দিন নির্ধারন করা হয় ৩০ এপ্রিল ১৯০৮ তারিখ।

এক পর্যায় আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষন। ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকি ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে অবস্থান নেন। এই ক্লাবে নিয়মিত আসতেন কিংসফোর্ড। দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন কিংসফোর্ডের গাড়ির মত দেখতে একটা গাড়ি উপস্থিত হয় সেই ক্লাবে। সেই গাড়িতে ছিলেন ব্রিটিশ ব্যারিস্টার প্রিংগল কেনেডির স্ত্রি ও কন্যা । ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকি বোমা ছুড়ে পালিয়ে যান। এতে ব্যারিস্টার প্রিংগল কেনেডির স্ত্রি ও কন্যা দুজনেরই মৃত্যু হয়।

ক্ষুদিরাম যেভাবে ধরা পড়েন :

পরবর্তিতে ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল দুজন দুদিকে রওনা দেন। ইতোমধ্যে সর্বত্র প্রচার হয়ে যায় এই ঘটনা। প্রফুল্ল চাকি সমস্তিপুর রেল স্টেশনে পৌছালে রেলওয়ে কর্মচারি ত্রিগুণ চরণ ঘোষ সব বুঝতে পেরে তাকে কলকাতা যাবার ব্যবস্থা করেন।

রেলগাড়ির কামরায় তার সাথে যাত্রি হিসেবে ওঠেন ব্রিটিশ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জি। প্রফুল্লর আলোচনা করে তিনি টের পান তিনিই পলাতক আসামি। নন্দলাল তাকে আটকের চেষ্টা করলে প্রফুল্ল পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সাথে থাকা পিস্তলের গুলিতে আত্মাহুতি দেন।

অন্যদিকে, ক্ষুদিরাম ২৫ কিলোমিটার হেটে তৎকালিন ওয়ানি রেল স্টেশনে পৌছান। দির্ঘ পথ হেটে হাপিয়ে ওঠা ক্ষুদিরাম স্টেশনে জলের খোজ করেন। কিন্তু স্টেশনে থাকা পুলিশ তার এ অবস্থা দেখে সন্দেহ করে। তাকে আটকের চেষ্টাকালে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তার সাথে থাকা পিস্তল মাটিতে পড়ে যায়। ধরা পরে যান ক্ষুদিরাম। বর্তমানে সেই রেল স্টেশনের নাম ক্ষুদিরামের নামে করা হয়েছে।

ধরা পড়ার পরবর্তি ঘটনা :
১ মে ক্ষুদিরামকে মুজাফফরপুর থেকে আনা হয় কোলকাতায় । তাকে দেখতে লোকজনের ভিড় জমে যায়। ইংরেজি পত্রিকা “স্টেটসম্যান” পরের দিন ঘটনার বর্ণনা দেয় এভাবে, “ছেলেটিকে দেখার জন্য রেল স্টেশনে ভিড় জমে গিয়েছিল। মাত্র ১৮ বা ১৯ বছরের ছেলে, অথচ তাকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখাচ্ছিল। রেলগাড়ির প্রথম শ্রেনির কামরা থেকে তার জন্য রাখা ঘোড়ার গাড়ির দিকে সে ভয় ভিতিহিন উৎফুল্ল এক বালকের মত হেটে গেল। সেখানে বসে সে সজোরে স্লোগান দিল, বন্দে মাতরম ! বন্দে মাতরম !”

কোর্টে জিজ্ঞাসাবাদ :

কোর্টে উঠানো হয় ক্ষুদিরামকে। ম্যাজিস্ট্রেটের জ্ঞিসাবাদে ক্ষুদিরাম হামলার সকল দায়িত্ব নির্ভয়ে স্বিকার করেন। এমনকি প্রফুল্ল চাকির কথাও চেপে যান। যদিও পরে আদালত জানতে পারে, প্রফুল্ল চাকিও এর সাথে সম্পৃক্ত। তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষন দিলে রায় শুনে তিনি মুচকি হাসি হাসেন। বিজ্ঞ জজ সাহেব অবাক হয়ে জানতে চান, তিনি এই রায়ের অর্থ বুঝেছেন কি না ? বির নির্ভিক ক্ষুদিরাম হেসে জানান, হ্যা। বলেন, “আমাকে একটু সময় দিলে আমি সারা ভারতবাসিকে শিখিয়ে দিতাম কি করে বোমা বানাতে হয়।”।

আপিল :

ক্ষুদিরামের পক্ষে অনেকজন বিজ্ঞ আইনজিবি লড়েন সম্পূর্ণ বিনা খরচায়। আপিলের উদ্দেশ্য ছিল, মৃত্যুদণ্ড থেকে শাস্তি কমিয়ে যাবজ্জিবন কারাদণ্ড পাওয়া। তাদের অনুরোধে ক্ষুদিরাম আপিল করার জন্য মত দেন। প্রখ্যাত বিজ্ঞ আইনজিবি নরেন্দ্র কুমার বসু নিম্ন আদালতের রায়ের বিভিন্ন ত্রুটি তুলে ধরেন। যেমন :

– ক্ষুদিরামকে প্রশ্ন করা এবং তার বক্তব্য লিখে রাখার জন্য তার মাতৃভাষা ব্যবহার করা হয় নি।

– যেদিন তার বক্তব্য নেওয়া হয় সেদিন তার স্বাক্ষর নেওয়া হয় নি।

– প্রফুল্ল চাকি ছিল তাদের দুইজনের মধ্যে বেশি শক্ত সামর্থ্য, সেক্ষেত্রে সেই বোমা ছুড়েছে প্রফুল্ল চাকি এবং বোমা বানাতে সে-ই সক্ষম ছিল।

– প্রফুল্ল যেহেতু আত্মহত্যা করেছে, তাহলে সেই বোমা হত্যার জন্য ছুড়েছিল এবং শাস্তি এড়াতে নিজেকে হত্যা করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।  কিন্তু বিজ্ঞ আদালত কোন যুক্তিই আমলে নেয়নি।

অত:পর ফাসি :

ফাসির রায়ে সারা বাংলা উত্তাল হয়ে উঠল। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন ঠিক করা হল ১১ অগাস্ট ১৯০৮, সকাল ৬ টা । ভোর ৫ টা থেকে লোকজন ভিড় করল। তার মৃতদেহ যখন রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল অজস্র মানুষ ফুল ছিটিয়ে তাকে শেষ বিদায় জানায়।

তৎকালিন বিখ্যাত পত্রিকা ‘অমৃতবাজার পত্রিকা‘ এবং বিখ্যাত ব্রিটিশ পত্রিকা ‘এম্পায়ার‘ লিখেছিল, ক্ষুদিরাম হাসতে হাসতে ফাসির মঞ্চে উঠেছিল। মাথায় কালো কাপড় দিয়ে ঢাকার আগ পর্যন্ত সে ছিল উৎফুল্ল ও তার মুখে ছিল স্মিত হাসি।

স্মরনিয় যুগে যুগে :

বৃটিশ বিরোধি আন্দোলনে আত্নত্যাগি ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে কবিতা লিখেছিলেন আমাদের জাতিয় কবি কাজি নজরুল। পিতাম্বর দাস মতান্তরে মুকুন্দ দাস লিখেন বিখ্যাত গান :

“একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি….

হাসি হাসি পরবে ফাসি, দেখবে ভারতবাসি”

“… হাতে যদি থাকত ছোরা,
তোর ক্ষুদি কি পড়ত ধরা, মা গো!
রক্ত-মাংসে এক করিতাম, দেখত জগতবাসী…
একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি…”

বৃটিশ বিরোধি আন্দোলনে আত্নত্যাগি :

আফসোস, আজ আমরা ভূলে গেছি এই ক্ষুদিরামদের কথা। যাদের আত্নবলিদানের জন্যই আজ আমি, তুমি, আমরা, স্বাধিন দেশের মাটিতে দন্ডায়মান।  যে স্বাধিন মাটিতে দাড়িয়ে বিস্তৃত নিল আকাশের নিচে, মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় ডানা ঝাপটে উড়ছি,  মুক্ত বাতাসে নিতে পারছি নিশ্বাস, চিৎকার করে বলছি, এ আমার দেশ, এ আমার মা, আমি এদেশের সন্তান ।

হে আত্নত্যাগি, তোমার এই আত্মবলিদান যারা আজ  ভুলে গিয়েছে তুমি তাদের ক্ষমা করে দিও !!