বৃহস্পতিবার , সেপ্টেম্বর ১৯ ২০২৪
হযরত আবু বকরের খেলাফতকাল
হযরত আবু বকরের খেলাফতকাল

হযরত আবু বকরের খেলাফতকাল

 “ইসলামি খেলাফতের চার অধ্যায়” এর আজকের উপস্থাপনা প্রথম অধ্যায় অর্থাৎ রাশেদিন খেলাফতের প্রথম খলিফা হযরত আবুবকর রা. এর খেলাফতকাল নিয়ে। এরপর আমরা একে এক উমর, উসমান এবং আলী রা. এর সময়কাল নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।

হযরত আবু বকরের খেলাফতকাল 632 থেকে 634

পরিচিতি : নাম আবদুল্লাহ, উপনাম আবু বকর। উপাধি আতিক, সিদ্দিক বা সত্যবাদি । পিতার নাম ওসমান। উপনাম আবু কুহাফা। মাতার নাম উম্মুল খায়ের সালামা বিনতে সাখার। তিনি ইসলামের প্রথম খলিফা, আশারায়ে মুবাশশরা তথা জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত। বিশ্বনবী সা: এর শ্বশুর। আবু বকর ৫৬৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৩৪ সালের ২৩ আগস্ট ইন্তেকাল করেন।

হযরত মোহাম্মদ (স) এর ওফাতের মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম যুগ ও নবুয়তের সমাপ্তি ঘটে। মুসলিম উম্মাহ হারায় তার অভিভাবক ও পথ প্রদর্শক। মদিনা রাষ্ট্র হয়ে পড়ে নেতৃত্ব শুন্য।

খিলাফতের আসন গ্রহণ : নবিজির কোন পুত্র সন্তান ছিলো না বা তিনি তার উত্তরসূরী হিসেবে রেখে যান নাই কাউকে। ফলে নবিজির ওফাতের পরে কে হবেন মুসিলিম উম্মার প্রতিনিধি কে দিবে ইসলামী রাষ্ট্রের নেতৃত্ব? এই নিয়ে শুরু হয় এক সংকটময় পরিস্থিতির।

এমন মুহুর্তে খিলাফতের সমস্যা সমাধানের জন্য আনসার মুহাজির সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মদিনার বানি সায়িদা নামক মিলনায়তনে মিলিত হন। উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে খেলাফতের প্রশ্নে চারটি দলের সৃষ্টি হয়। তখনো নবীজির দাফন কাফন সম্পন্ন হয়নি।

প্রথম দল মুহাজির : তারা দাবি করে তারাই সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছেন এবং ইসলামের জন্য সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সুতরাং খলিফা নির্বাচিত হবে মুহাজিরদের মধ্য থেকে।

দ্বিতীয় দল আনসার : তারাও দাবী করে ইসলামের দুর্দিনে মহানবী (সা) ও মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং সর্বপ্রকার সাহায্য সহায়দা প্রদান করেছেন। তাই তাদের ভেতর থেকেই হবে খলিফা।

দ্বিতীয় দল কুরাইশ : তাদের দাবী, মুহাম্মদ কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহন করেছেন। আর এই বংশ প্রাচীন কাল থেকেই মক্কায় নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। খলিফা তাদের ভেতর থেকেই হওয়া উচিত।

চতুর্থ দল আলী র সমর্থক : তাদের দাবী, আলী মহানবীর চাচাতো ভাই। এবং তার একমাত্র জিবীত কণ্যা ফাতেমার স্বামী। সুতরাং মহানবীর যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে আলীকেই খফিলা বানানো উচিত।

রাজনৈতিক জটিলদা যখন চরমে পৌছলো হযরত আবু বকর জোড় কন্ঠে ঘোষনা করেন : ইসলামের যুগ সন্ধিকালে আনসারদের অবদান চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আরবের লোকেরা কেবল কুরাইশ বংশ থেকেই কোন ব্যক্তিকে খলিফা হিসেবে মেনে নিবে। যেহেতু নবীজর জন্ম এই বংশে। তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষমতার কথা স্মরন করে দিয়ে, আবু বকর কুরাইশদের বংশ থেকে খলিফা নির্বাাচনের মতামত ব্যক্ত করেন।

এই প্রেক্ষাপটে আনসারগন প্রনরায় প্রস্তাব করে, কুরাইশ ও আনসারদের মধ্য থেতে দুই জনকে খলিফা নির্বাচিত করা হোক।

হযরত ওমর এর প্রতিবাদ করে বলেন, এক খাপে যেমন দুইটি তরবারি স্থান পায় না। তেমনি এক রাষ্ট্রে দুইজন খলিফা হতে পারেনা।  দুইজন খলিফা নির্বাচিত হলে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বিনষ্ট হবে। অতপর অরাজকতা ও অচলাবস্থা দূরীকরনে আবু  বকর বিখ্যাত সাহাবী আবু উবায়দা অথবা ওমর কে খলিফার দায়িত্ব গ্রহনের অনুরোধ করেন।

হযরত উমর আর আবু উবায়দা বয়স, পদর্মাদা ও সন্মান বিবেচনা করে আবু বকর কে মদিনা রাষ্ট্রের পরবর্তী নেতা বা খলিফা হওয়ার ঘোষনা দেন এবং তার হাতে বাইয়াত গ্রহন করেণ। এরপর আবু উবায়দা, আব্দুর রহমান, উসমান, আলী (রা) সহ সকল আনসার, মুহাজীররা আবু বকর (রা) এর হাতে বাইয়াত গ্রহন করেণ এবং খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

এভাবে আবু বকর (রা) খলিফাতুল রাসূল বা রাসূলের উত্তরসূরী অর্থাৎ খলিফা নির্বাচিত হন এবং এর মাধ্যমে মুসলিম জাতি খলিফা নির্বাচনের সংকট থেকে মুক্তি পায়। সুচনা হয় রাশেদিন খেলাফতের প্রথম অধ্যায় তথা ইসলামের সোনালী যুগের ।

হযরত আবু বকরের খেলাফতকাল ইসলামের সোনালী যুগের সুচনা : আবু বকর (রা) মহানবী (সা) এর ওফাতের পর সৃষ্ট বিভিন্ন বিদ্রোহ বিশৃংখলা দমন করে, ইসলামী রাষ্ট্রে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্টা করেন। বিশেষ করে যাকাত অস্বীকারকারী এবং ধর্মত্যাগী ভন্ডনবীদের দমন করে, মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে তিনি সক্ষম হন। 

সমস্যা : খলিফার আসনে অধিষ্টিত হয়ে আবু বকর যেসব সমস্যার সম্মুখীন হন :

  1. কিছু সংখ্যক লোকের যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি;
  2. কিছু গোত্রের মুরতাদ হওয়া বা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ;
  3. কয়েকজন ভণ্ড নবীর আবির্ভাব।

১. যাকাত দানে অস্বীকৃতি : একদল মুসলমান সিদ্ধান্ত নেয়, তারা রোজা রাখবে, নামাজ পড়বে কিন্তু যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে নতুন খলিফা হযরত আবু বকর রা: তাদের কথা শুনে ভীষণ রেগে যান এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

হযরত উমর রা: বললেন, তাদের বিরুদ্ধে আপনি কিভাবে যুদ্ধ করবেন ? যারা যকাত ছাড়া অন্য সব ইবাদত পালনক করার ঘোষণা দিচ্ছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কালেমার সাক্ষ্য না দেয়া পর্যন্ত আমাকে মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারা তো কালেমার সাক্ষ্য দিচ্ছে।

হযরত আবু বকর রা: বলেন, নামাজ যাকাত উভয়ই ফরজ। আল্লাহ উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করেননি। আল্লাহর শপথ! যদি তারা একটি রশিও দিতে অস্বীকার করে, যা তারা রাসূলুল্লাহ সা: এর সময় প্রদান করত, অবশ্যই তা প্রদানে অস্বীকৃতির কারণে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করব নিজের ভুল বুঝতে পেরে উমর রা: যুদ্ধে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

অতঃপর আবুবকর রা: হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদের নেতৃত্বে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রা: তাদেরকে বন্দী করেন। অতঃপর তারা যাকাত দানের প্রতিশ্রুতি দেয়।

২. মুরতাদ বা ধর্মত্যাগ : মহানবী সা: এর ওফাতের সাথে সাথে তিনটি মসজিদের বাসিন্দা ছাড়া আরবের সব লোক মুরতাদ তথা স্বীয় ধর্ম ত্যাগ করেছিল। মসজিদ তিনটি হলো :

  1. মসজিদে হারাম; মক্কায় অবস্থিত।
  2. মসজিদে নববী; মদিনায় অবস্থিত।
  3. মসজিদে জুয়ায়ি। মদিনার বাইরে মসজিদেই সর্বপ্রথম জুমার নামাজ পড়া হয়। যা বাহরাইনে অবস্থিত।

যাকাত দিতে অস্বীকার কারীরাও মুরতাদদের অন্তর্ভুক্ত আরো কিছু গোত্র মুরতাদ হয়েছিল। তারা হলো : বনি ফাজারাহ, বনি গাতফান, বনি সুলাইম, বনি ইয়ারবু বনি তামিমের কিছু লোক (তাদের মধ্যে ভণ্ড নবীর দাবিদার মুসায়লামা কাজজাবের স্ত্রীও ছিল), বনি কুনদাহ এবং বনি বকর বিন ওয়ায়েল। আবুবকর রা: এসব গোত্রকে সম্পর্ণরূপে পরাস্ত করে সত্য দ্বীন ন্যায় রাষ্ট্রের ভিত মজবুত করেন।

৩. ভণ্ড নবীর আবির্ভাব : আবুবকর রা: এর শাসনামলে তিনজন ভণ্ড নবীর আবির্ভাব ঘটে। তারা হলো :

  • আসওয়াদ আনামি : বনি মুজহারের সর্দার। সে ছিল একজন দক্ষ জাদুকর গণক। রাসূল সা: এর সময়ই ইয়েমেনে সে নবুয়ত দাবি করে। সে ইয়েমেনের একটি শহর দখল করেছিল। মহানবী সা: ইয়েমেনের গভর্নর হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা: কে আসওয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দিলে, হযরত মুয়াজ রা: এর নির্দেশে ফিরোজ দায়লামি আসওয়াদকে তার গৃহে হত্যা করেন। কিন্তু মহানবী সা: এর কাছে সংবাদ পৌঁছার আগেই মহানবী সা: ইন্তেকাল করেন।
  • মুসায়লামা কাজজাব : বনি হুনাইফার সর্দার। দশম হিজরির শেষ ভাগে নবুয়ত দাবি করে। তার ধারণা মুহাম্মদ সা: এর সাথে তাকেও নবুয়ত দেয়া হয়েছে। সে দুজন দূতের মাধ্যমে রাসূল সা: এর কাছে পত্র প্রেরণ করে যে, এই পৃথিবীর অর্ধেক আপনার আর বাকি অর্ধেক আমার  । রাসূল সা: বলেন, ‘যদি দূত হত্যা করা জায়েজ হতো, তবে আমি তোমাদেরকে হত্যা করতাম।রাসূল সা: পত্রের জবাবে বলেন, ‘পৃথিবী আল্লাহর, তিনি যাকে ইচ্ছা নবুয়ত দান করেন। এর কিছুকাল পরেই মহানবী সা: ইন্তেকাল করেন। আবুবকর রা: হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। যুদ্ধে হয়রত ওয়াহশি বল্লমের আঘাতে মুসায়লামা কাজজাবকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেন।
  • তুলায়হা ইবনে খুয়াইলিদ : বনু আসাদের সর্দার ছিল সে। নবুয়ত দাবিদারদের মধ্যে সেই ছিল সর্বশেষ ব্যক্তি। মহানবী সা: এর ওফাতের আগেই সে নবুয়ত দাবি করেছিল। হজরত আবুবকর রা: তার বিরুদ্ধে হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রা: কে প্রেরণ করলে তুলায়হা ভয়ে সিরিয়া চলে যায়। কিছুদিন সেখানে বসবাসের পর পুনরায় মুসলমান হয়ে মদিনায় ফিরে আসে এবং খাঁটি মুমি হিসেবে জীবন যাপন করে।

উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা বলেন, রাসূল সা:-এর ওফাতের সাথে সাথে আরব বাসীর অনেকে মুরতাদ হয়ে যায়। আমার পিতার কাধে আপতিত হয় চরম মুসিবত। ওই মুসিবত কোনো পাহাড়ের ওপর পতিত হলে নিশ্চয় সেই পাহাড়ের চূড়া ভেঙে পড়ত

হযরত আবু বকরের মৃত্যুর পর খেলাফতে অধিষ্টিত হন হযরত উমর রা. । পরের পর্বে আমরা জানবো কেমন গিয়েছিলো হযরত উমরের শাসন কাল, রাষ্ট্র পরিচালনা, ধর্ম প্রচার। তার সময়ে কেমন কেটেছিলো মুসলিম উম্মাহর জীবনকাল।

image_printআর্টিকেল প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন বিষয়ে জানতে ক্লিক করুন

About মোহাম্মদ শওকত আকবার

Showkatbd.com এর প্রতিষ্ঠাতা এবং একজন ব্লগার। চলমান ব্লগিং ল্যান্ডস্কেপকে আমি নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছি। আমি শুধু একটি ব্লগ নিয়েই নয়; একটি অপরিহার্য বহুমুখী প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করছি। "Many more in one” শ্লোগানে যার পথচলা। যে ব্লগ হবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল বাংলা ভাষা ভাষিসহ অনলাইন ব্যবহারকারীদের প্রতি মুহূর্তের এক অপরিহার্য প্লাটফর্ম । তাদের অনলাইন সেবা প্রদানেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। ”সম্পূর্ন একটি সেবামূলক সাইট”

Check Also

সালামের প্রচলন যেভাবে

সালামের প্রচলন যেভাবে

এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে অভিবাদন ও সম্ভাষণ জানানোর ইসলামী রীতি হচ্ছে السلام عليكم ’আসাসালামু আলাইকুম’ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Language »
error: Content is protected !!