
শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত শান্ত একটি গ্রাম, যেখানে সবাই মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করত। গ্রামের মাঝখানে একটি বিশাল বটগাছ ছিল, যেখানে গ্রামবাসীরা বিকেলের অবসরে জড়ো হয়ে গল্প করত। গ্রামের পরিবেশ এতটাই শান্ত ছিল যে সেখানে কখনো অপরাধের খবর পাওয়া যেত না। তবে একদিন এমন একটি ঘটনা ঘটল, যা পুরো গ্রামকে হতবাক করে দিল।
সেই সকালে গ্রামের ধনী ব্যবসায়ী রমেশবাবুর বাড়ি থেকে চিৎকার ভেসে এলো। তাঁর ঘরের আলমারি থেকে অনেক টাকা আর গয়না চুরি হয়ে গেছে। গ্রামবাসীরা জড়ো হলো এবং সবাই অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, এত নিরাপদ গ্রামে এমন ঘটনা ঘটল কীভাবে! রমেশবাবু খুব রাগান্বিত হয়ে বললেন, “এটা গ্রামবাসীরই কারো কাজ। চোরকে ধরা না হলে আমি সবাইকে সন্দেহ করব।”
গ্রামের সবাই এই কথায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। কেউ কাউকে সন্দেহ করতে চাইছিল না, কারণ গ্রামে সবাই একে অপরকে ভালোভাবেই চিনত। কিন্তু চোর কে ছিল?
এদিকে, গ্রামের এক কোণে বাস করত এক গরিব কৃষক, নাম তার হরিলাল। সে খুবই দরিদ্র, কিন্তু সৎ। গ্রামের সবাই জানত, হরিলাল কখনো কোনো অন্যায় কাজ করতে পারে না। তবুও, তার দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই মনে মনে সন্দেহ করতে লাগল। রমেশবাবুও সন্দেহ করলেন এবং হরিলালের বাড়িতে এসে বললেন, “তুমি তো গরিব। নিশ্চয়ই তুমিই চুরি করেছ। আমার টাকাগুলো ফিরিয়ে দাও।”
হরিলাল হতবাক হয়ে বলল, “আমাকে ভুল বোঝবেন না, আমি চুরি করিনি।” কিন্তু কেউ তার কথা বিশ্বাস করল না। গ্রামের মোড়ল হরিলালকে শাস্তি দেওয়ার হুমকি দিলেন। হরিলাল নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য কেঁদে কেঁদে সবার কাছে অনুরোধ করল, কিন্তু তার কথা কেউ শুনল না।
অন্যদিকে, রমেশবাবুর বাড়ির এক কর্মচারী, রবি, এই পুরো ঘটনাটি দূর থেকে দেখছিল। সে জানত চুরি করার পেছনে কার হাত রয়েছে। আসলে চুরি করেছিল রমেশবাবুরই নিজের ভাগ্নে, বিকাশ। বিকাশ শহর থেকে এসেছিল, এবং সে ছিল এক অভ্যস্ত জুয়াড়ি। প্রচুর ঋণের দায়ে সে এমন একটি কাজ করে বসে, যা তার নিজের কাকাকে অপদস্থ করে।
রবি প্রথমে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছিল না, কারণ বিকাশ ছিল ধনী এবং প্রভাবশালী। কিন্তু যখন সে দেখল, নিরপরাধ হরিলালকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে, তখন সে আর চুপ থাকতে পারল না। রাতে সে গোপনে রমেশবাবুর কাছে গিয়ে পুরো ঘটনাটি খুলে বলল।
রমেশবাবু প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননি, কারণ বিকাশ তাঁর প্রিয় ভাগ্নে। তবে রবি তাঁকে একটি প্রমাণ দেখাল—বিকাশের ঘরে চুরি যাওয়া গয়নাগুলো লুকানো ছিল। রমেশবাবু নিজে গিয়ে প্রমাণ দেখে হতবাক হয়ে গেলেন।
পরদিন সকালে তিনি গ্রামবাসীদের সবাইকে ডেকে সত্য ঘটনা প্রকাশ করলেন। তিনি প্রকাশ্যে বিকাশকে তিরস্কার করলেন এবং পুলিশে সোপর্দ করলেন। গ্রামবাসীরা স্বস্তি পেয়েছিল, কিন্তু রমেশবাবু হরিলালের কাছে ক্ষমা চাইতে লজ্জা পাচ্ছিলেন।
তবুও, তিনি হরিলালের কাছে গেলেন এবং বললেন, “আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি। আমার জন্য তোমার অনেক অপমান হয়েছে। আমি খুব লজ্জিত।” হরিলাল তাঁকে ক্ষমা করে দিল, কারণ সে জানত, অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়া কখনো সঠিক পথ নয়।
বিকাশ শাস্তি পেল এবং জেলে গেল। গ্রাম আবার শান্তিতে ফিরল। এই ঘটনার পর রমেশবাবু আরও সতর্ক হয়ে গেলেন এবং হরিলালের মতো সৎ মানুষের প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হলেন। গ্রামবাসীরা বুঝতে পারল, অপরাধী তার অপরাধের শাস্তি একদিন পাবেই। সত্যকে কখনো দমিয়ে রাখা যায় না, আর নির্দোষ ব্যক্তিকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে দোষী করা যায় না।
এভাবেই গ্রামে আবার শান্তি ফিরে এলো। কিন্তু এই ঘটনার শিক্ষা সবাই মনে রাখল—অন্যায় করে কেউ কখনো পার পায় না। একজন অপরাধী যত শক্তিশালীই হোক না কেন, সত্যের সামনে তাকে একদিন নত হতেই হয়।