বৃহস্পতিবার , সেপ্টেম্বর ১৯ ২০২৪

গনহত্যা যুগে যুগে

গনহত্যা যুগে যুগে : এক শ্রেনির মানুষ যুগে যুগে নিজের আধিপত্য বিস্তারে ইচ্ছাকৃতভাবে কৌশলে মানুষ হত্যা করতে এতটুকুও কার্পন্য করে নাই। তাদের এই মানব হত্যার হলিখেলাই অভিধানে গনহত্যার স্বিকৃতি পেয়েছে। ধর্মিয়, জাতিয়, বর্ণবাদি ও উপজাতি গোষ্ঠিকে ইচ্ছাকৃতভাবে কৌশলে নিশ্চিহ্ন বা ধ্বংস করে দেওয়াকে বলা হয় গণহত্যা । শাসকগোষ্ঠি নিজের ইচ্ছে মত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও স্বার্থসিদ্ধি করতে হাজার হাজার মানুষ কে ইচ্ছা করে হত্যা করে।

প্রাচিন ও আধুনিক সমাজে গণহত্যা বিশ্বের বিচিত্র সম্পদ আর ভূমি অর্জনের জন্য একজন ঘৃণিত নির্দয় ব্যক্তির আদেশেই পরিচালিত হতো। তারা রচনা করে যেত কলংকিত এক একটি অধ্যায়।  যুগে যুগে এই কুখ্যাত ব্যক্তিরা চলে গেলেও তাদের বর্বরোচিত গণহত্যার সাক্ষ্য দেয় ইতিহাস। বিশ্বের অন্যতম বর্বরোচিত কিছূ গণহত্যার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরছি  আজ ।

গনহত্যা যুগে যুগে

বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানি নাগরিকদের গণহত্যা :

মার্চ ১৯৭১ । পশ্চিম পাকিস্থানের সেনাবাহিনি চালায় পুর্ব পাকিস্তানে অপারেশন সার্চ লাইটের অধিনে এক নরকিয় বর্বর গনহত্যা। পুর্ব পাকিস্থানের স্বাধিকার আন্দোলনকে চিরতরে নির্মুল করে দিতে পরিচালনা করে এই নারকিয় গনহত্যা।

দির্ঘ নয় মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহায়তাকারী দলগুলোর সমন্বয়ে আনুমানিক ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে। এছাড়াও লক্ষ বাঙালী নারিদের নির্যাতন ও ধর্ষণ করে। আর এই গণহত্যাটি স্বিকৃতি পায় বিশ্বের অন্যতম জঘন্য গণহত্যা হিসেবে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশিদের গণহত্যা (listverse.com)

আল-আনফাল গণহত্যা :

ইরান-ইরাক যুদ্ধের শেষের দিকে ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ইরাকের কুর্দি অধ্যূষিত শহর হালাবজায় আলি হাসান আল-মাজিদ ওরফে ‘কেমিক্যাল আলি’ র নির্দেশে রাসায়নিক গ্যাস হামলা চালানো হয় ৷ সেই হামলায় প্রায় 1 লাখ 80 হাজার কুর্দি নিহত হয়। ইতিহাসে সেই গনহত্যাই আল-আনফাল অভিযান, কুর্দি গণহত্যা বা অপারেশন আনফাল নামে পরিচিত।  সে সময় আলি- মাজিদ ওরফে ‘কেমিক্যাল আলি’ ছিলেন সাদ্দামের উত্তরাঞ্চলীয় ব্যুরোর কম্যান্ডার৷ এই গণহত্যার মাধ্যমে তাদের শতকরা ৯০ ভাগ লক্ষ পূরণ হয়েছিল।

আল-আনফাল গণহত্যা (listverse. com)

আর্মেনীয় গণহত্যা :

বিংশ শতাব্দির সর্ববৃহৎ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিলো তুরস্কে। অটোম্যান শাসনামলে। তৎকালিন সেনাবাহিনির কর্মকর্তা আনোয়ার পাশার নেতৃত্বে  প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালিন ও তৎপরবর্তি সময়ে তুরস্ক শুধু 1.8 মিলিয়নের অধিক আর্মেনিয় ও অ-তুর্কিদের সরাসরি হত্যা করে। দেশ থেকে করে বিতাড়িত । তাছাড়াও হাজার হাজার আর্মেনীয় ও অ-তুর্কীদের খাদ্যাভাবে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করে। আধুনিক তুর্কিরা এটাকে গণহত্যা বলে স্বিকার করে না। বরং তারা বলেন, এটা সে সমস্ত ব্যক্তিদের জন্য একটি গণবিতাড়ন প্রক্রিয়া ছিলো, যারা রাশিয়ার সাথে যুক্ত ছিল।

আর্মেনীয় গণহত্যা (RTVE.es)

হিরোশিমা ও নাগাসাকি গণহত্যা :

৬ আগষ্ট ১৯৪৫ সাল। অতর্কিতভাবে জাপানের হিরোসিমা শহরের উপর লিটন বয় নামক পারমানবিক বোমা ফেলে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনি। সম্পূর্নরুপে ধ্বংস হয় হিরোশিমা। আবার ৯ আগস্ট সকাল ১১টা ২ মিনিটে ২০ কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বোমা “ফ্যাটম্যান” পারমাণবিক বোমাটি নিক্ষেপ করে নাগাসাকিতে। যাতে পুরো শহরটি পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

এই লিটল বয় আর ফ্যাটম্যানের আঘাতে প্রান হারায় 2 লক্ষ 70,000 লোক । ইতিহাসে রয়ে যায় জঘন্যতম এই পারমানবিক বোমা হামলার ইতিবৃত্ত।

নাগাসাকিতে বোমা হামলার পরের দৃশ্য (Quartz)

দ্যা হলোকাস্ট গণহত্যা :

পৃথিবীর অন্যতম গণহত্যার আরেকটি হলোকাস্ট গণহত্যা। দ্বিতিয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় উহুদি ধর্মাবলম্বিদের চালানো গনহত্যা। হিটলারের নাৎসি বাহিনী কর্তৃক ইহুদিদের ইউরোপ মহাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণার প্রেক্ষিতে প্রায় 11 মিলিয়ন লোককে হত্যা করেছিলো। নাৎসিরা এর নাম দিয়েছিল “ইহুদি প্রশ্নের চরম উপসংহার”। এই গণহত্যা বিভিন্নভাবে সম্পন্ন করা হয়েছিল। সরাসরি হত্যা, অনাহারে হত্যা , অতিরিক্ত কষ্টসাধ্য কাজের বোঝা চাপিয়ে হত্যা, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেনিয়ে হত্যা। হিটলারের এই জঘন্যতম হত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে নিষ্ঠুর গণহত্যাহিসেবে পরিচিত।

দ্যা হলোকাস্ট গণহত্যা (Trendsmap)

রুয়ান্ডা গণহত্যা :

রুয়ান্ডার গণহত্যা বলতে ১৯৯৪ সালে সেদেশের সংখ্যালঘু টাট্‌সি/তুশি গোষ্ঠীর মানুষ এবং সংখ্যাগুরু হুটু গোষ্ঠীর মধ্যে উদার ও মধ্যপন্থীদের নির্বিচারে হত্যার ঘটনাকে বোঝায়। তাদের চরম পর্যায়ে বৃদ্ধি পেতে থাকা উপজাতীয় বিভেদের ফলে সংঘটিত হয় এই পাশবিক গণহত্যা। ১৯৫৯ সালে তুতসি রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে হুতুরা।

১৯৬২ সালের কথা তখন হুতু সম্প্রদায় বিদ্রোহ শুরু করে ক্ষমতাসীন তুশি সম্প্রদায়ের উপর। তাদের তীব্র উত্তেজনা ও বিদ্রোহ একপর্যায়ে যুদ্ধে মোড় নেয়। আর সেই সময় হুতু সম্প্রদায় তুশি সম্প্রদায়কে হত্যা করতে শুরু করে। এই গণহত্যার কারণে মরতে হয় প্রায় ৫ লাখ লোক থেকে ১০ লাখ লোকের। তুসি সম্প্রদায় শতাব্দী ধরে দমিয়ে রেখেছিল আরেকটি উপজাতি হুতু সম্প্রদায়কে শুধু তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে।

রোয়ান্ডা গণহত্যা (AFP)

বসনিয়া গণহত্যা :

1992 সাল। এপ্রিল মাস। যুগোস্লাভিয়া প্রজাতন্ত্রের বসনিয়া হার্জেগোভিনা সরকার যোগোস্লোভিয়া থেকে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ঘোষনা পরবর্তি কয়েক বছর সার্ব বাহিনি বসনিয়ার বেসামরিক মুসলমান ও ক্রোয়েশিয়দের লক্ষ করে বর্বর হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। 1995 সাল পর্যন্ত 1 লাখ লোককে হত্যা করে সার্ব বাহিনি। দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই ছিল গনহত্যার নিকৃষ্টতম এক উদাহরন 

বসনিয়ান গণহত্যা (Vpro)

সোভিয়েত রাশিয়ার স্ট্যালিন যুগ :

জোসেফ স্ট্যালিন বিংশ শতাব্দীর কুখ্যাত এক গণহত্যা কারীর নাম। স্ট্যালিন অর্থ ম্যান অব স্টিল, যাকে শব্দটির অর্থ ম্যান অব স্টিল, বাংলায় যাকে লৌহমানব বলে। যে তালিকায় রয়েছে বিশ্বের আরও দুজন: হিটলার মাওসেতুং। জোসেফ তার এই অপকর্ম করেছিলে নকারাগারে বন্দি থেকে তার প্রতিষ্ঠিত এক্সটারমিনেশন ক্যাম্পের মাধ্যমে। ধারনা করা হয় স্ট্যালিন তার শাসনামলে আনুমানিক ২০ লক্ষ লোকদের হত্যা করেন। আর এই 20 লাখ লোকের মধ্যে 2 লাখ লোক ছিলো ইউক্রেনীয়ান কৃষক। এছাড়াও তিনি রাশিয়ার সেনাকর্মকর্তা বুদ্ধিজীবীদের নির্বাসনে পাঠিয়ে হত্যা করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে ০০৪৪৭ অধ্যাদেশ দ্বারা অসংখ্য মানুষ কে হত্যা করেছিলেন সামাজিকভাবে ক্ষতিকর আখ্যা দিয়ে।

জোসেফ স্ট্যালিন; Image Source: Sovfoto via Britannica

আইরিশ আলু দুর্ভিক্ষ:

শত বছর ধরে ব্রিটিশ ও আইরিশ ক্যাথলিকদের মধ্যে মতবিরোধ ছিলো। সম্পর্ক ছিলো খুবই খারাপ। ব্রিটিশরা সরাসরি যখন আইরিশদের নিশ্চিহ্ন করতে পারছিলো না তখন তাদের প্রধান ফসল আলু তে এক ধরনের ছত্রাক দ্বারা রোগ ছড়িয়ে দিলো। যার ফলে আইরিশদের আলু দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হলো।

আয়ারল্যান্ড ছিলো উর্বর ভূমি। অনেক বছর ধরে তাদের ফলিত খাদ্য শস্য দ্রব্য ইংল্যান্ডে রফতানি করে আসছিলো। হঠাৎ যখন আইরিশদের শস্যতে ক্ষয় রোগের প্রকোপ দেখা দেয় তখন ইংল্যান্ড আইরিশদের জন্য তাদের বন্দর বন্ধ করেদিলোযার ফলে আইরিশরা আরও হুমকির মুখে পড়লো।

সেই সময় ১৮৪৬ সাল থেকে ১৮৫২ সাল পর্যন্ত প্রায় হাজার হাজার মানুষ অনাহারে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেল। আর সঠিক সময়ে আইরিশ এই কৃষকরা ধনি ব্রিটিশ ভূমি মালিকদের খাজনা না দিতে পারায় অনেক অত্যাচার, নির্যাতন শুরু করে। আর এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে প্রায় দশ লক্ষ লোক মারা যায় আর অসংখ্য লোক দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।

আইরিশ দুর্ভিক্ষে মারা যাওয়া লোকদের স্মরণে স্মৃতিচিহ্ন (The Wild Geese)

image_printআর্টিকেল প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন বিষয়ে জানতে ক্লিক করুন

Check Also

জীবনকে উপভোগ করার নাম সংসার

জীবনকে উপভোগ করার নাম সংসার

জীবনকে উপভোগ করার নাম সংসার! যুগ যুগ একই ছাদের নিচে থেকেও, অনেক সময় একজন অন্যজনের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Language »
error: Content is protected !!