আয়না বিবি ছিলেন এক সাধারণ গ্রামীণ মহিলা, যার জীবনের শুরুটা ছিল সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরপুর। তিনি ছিলেন শৈশব থেকেই দারুণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। বিয়ের পর তার জীবনে আরও আলো ছড়িয়ে পড়ে। স্বামীর ঘরে আসার পর থেকে তিনি এক আদর্শ গৃহিণী হিসেবে সংসারের দায়িত্ব পালন করেন। তার স্বামী ছিলেন অর্থবান ও সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি। তাদের তিনটি সন্তান—দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে, যাদের নিয়ে আয়না বিবি ও তার স্বামী একটি সুখী পরিবার গড়ে তুলেছিলেন।
তাদের জীবন ছিল স্বপ্নময়। সন্তানদের লেখাপড়া, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা—সবকিছুই ছিল সুশৃঙ্খল। আয়না বিবি কখনো ভাবেননি যে তার জীবনের এক সময় এমনভাবে বদলে যাবে। কিন্তু সময় মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনে, কখনো ভালো, কখনো কঠিন।
যদিও তার শুরুটা সুখের ছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। প্রথমে তার স্বামী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অল্প দিনেই মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যু আয়না বিবির জীবনে এক কঠিন আঘাত হয়ে আসে। এতদিন যে মানুষটি তার জীবনের সব ভার নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন, তার চলে যাওয়া যেন আয়না বিবিকে দিশাহীন করে তোলে।
স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে আয়না বিবির কাঁধে। তিনি চেষ্টা করেছিলেন সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে। কিন্তু সন্তানেরা বড় হওয়ার পর ধীরে ধীরে নিজেদের পরিবার ও জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সন্তানেরা পড়াশোনা শেষ করে শহরে পাড়ি জমায়। প্রথমে তারা মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেও সময়ের সঙ্গে তা কমতে থাকে। শহরের চাকরি, পরিবার এবং নানা দায়িত্বের কারণে তারা মায়ের খোঁজ নেওয়া প্রায় ভুলে যায়। অথচ আয়না বিবি প্রতিদিন তার সন্তানদের জন্য অপেক্ষা করতেন। প্রতিদিন তার মনে একটি আশা কাজ করত—“আজ হয়তো কেউ ফোন করবে” বা “হয়তো কেউ দেখা করতে আসবে।” কিন্তু বেশিরভাগ সময় তার অপেক্ষা অপূর্ণই থেকে যেত।
আয়না বিবি গ্রামের বাড়িতে একা দিন কাটাতে থাকেন। একসময় তার শরীর দুর্বল হতে থাকে। আগের সেই শক্তি আর থাকে না। তিনি নিজের ছোটখাটো কাজও করতে কষ্ট অনুভব করতেন। কিন্তু তার পাশে তখন কেউ ছিল না, যে তার খেয়াল রাখবে। সন্তানদের প্রতি তার ভালোবাসা অটুট ছিল, কিন্তু তার সন্তানরা সেই ভালোবাসার মূল্য দিতে ব্যর্থ হয়।
জীবনের শেষ দিনগুলোতে আয়না বিবি খুবই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগে তিনি তার পুরোনো সুখের দিনগুলোর কথা স্মরণ করতেন। তিনি ভাবতেন, “কী ভুল করেছিলাম, যে আজ এমন হলো?” তার মনে পড়ে যেত ছোটবেলার সেই দিনগুলো, যখন তার সন্তানরা তার পাশে থাকত, তার যত্ন নিত।
মৃত্যুর ঠিক আগে তিনি বারবার সন্তানদের নাম ধরে ডাকতেন। হয়তো তিনি তাদের শেষবারের মতো দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তার সন্তানদের কেউই তাকে দেখতে আসেনি। একদিন সকালে তার নিঃসঙ্গ ঘরেই তিনি নিঃশব্দে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
আয়না বিবির জীবন আমাদের জন্য এক বড় শিক্ষা। তিনি জীবনের শুরুতে ছিলেন একজন সম্মানিত নারী, যার চারপাশে ছিল সুখ ও সম্পদ। কিন্তু জীবনের শেষ ভাগে তিনি নিঃসঙ্গতায় এবং অবহেলায় দিন কাটিয়েছেন। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পরিবার ও সম্পর্কের গুরুত্ব কতখানি। সন্তানদের উচিত তাদের অভিভাবকদের প্রতি যত্নশীল থাকা, কারণ একজন মা-বাবা তাদের পুরো জীবন উৎসর্গ করেন সন্তানের জন্য। অথচ আয়না বিবির জীবনে তার সন্তানরা সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পারেনি।
এই গল্পটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের সম্পর্কগুলোকে মূল্য দেওয়া জরুরি। যাদের কারণে আমরা আজকের আমরা, তাদের কখনো ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তা না হলে একদিন হয়তো আমরাও আয়না বিবির মতো একাকিত্বের শিকার হব।